বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট, ২০১৪
মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২
খিয়াংদের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র/Khyang Musical Instruments
খিয়াংদের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র:
খিয়াং সমাজে এক সময় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিজেরা তৈরী করে ব্যবহার করত । তাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা এই বাদ্য যন্ত্রটি ব্যবহার করে । কালের আবর্তে এই বাদ্যযন্ত্র গুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে । খিয়াংদের ব্যবহৃত কিছু বাদ্যযন্ত্রের তালিকা দেয়া হল ।
১। হ্ঙিয়াং - ম্রো আদিবাসীদের মত বাঁশি
২। চিং - ঢোল
৩। তেংতেলেহ্ - গোলাকারের ঢোল
৪। ক্রেই/ক্লেই- বাঁশের বাঁশি
৫। চোং- গীতারের মত দেখতে । এই বাদ্যযন্ত্রটিতে তিনটি তার থাকে ।
৬। ডিংকোলোকোং- বড় আকারের বাঁশের টুকরাটি ছিদ্র করে তৈরী করা হয় ।
৭। খিংখোং- বাঁশের তৈরী । এটি মুখ দিয়ে বাঁজায় ।
৮। রাংখোয়াং-জুরি
১। হ্ঙিয়াং: এই বাদ্যযন্ত্রটি ম্রো আদিবাসীরা বর্তমানে ব্যবহার করতে দেখা যায় । অতীতে এই ম্রো বাঁশিটি খিয়াংরা তাদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণে ব্যবহার করত । খিয়াংরা এই বাদ্যযন্ত্রটি বাঁশের বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে তৈরী করে থাকে । খিয়াংদের জীবন থেকে এটি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে । এই বাদ্য যন্ত্রটি ব্যবহার করতে আর দেখা যায় না । যখন থেকে হারমোনিয়ামের প্রচলন শুরু হয়, তখন থেকে হ্ঙিয়াং বাদ্যযন্ত্রটির ব্যবহার থেকে বিরত থাকে বলে জানা গেছে । বর্তমানে কিছু কিছু খিয়াং পরিবারে হারমোনিয়াম ব্যবহার করতে দেখা যায় ।
২। চিং (ঢোল) : আমি ছোট বেলায় রাজস্থলীতে আত্মীয়ের ঘরে দেখেছি নিজেদের বানানো ঢোল । এটি প্রথমে গাছের ভিতরের অংশ খোদাই করে তারপর শিকার করা হরিণের চামড়া, ছাগলের চামড়া অথবা গয়ালের চামড়া দিয়ে তৈরী করা হয়। এই ঢোল বেশীর ভাগ ব্যবহার করে জুমের ঘরে । জুমের মধ্যে বন্য প্রাণীদের উৎপাত দেখা দিলে ঢোল বাঁজিয়ে তাড়িয়ে দেয় । তাছাড়া ঢোল বাঁজিয়ে গান করে । কোন পরিবারে যদি মৃত দেহ সৎকার করে, তখনো ঢোল বাজিয়ে মৃত দেহকে স্ব-সম্মানে দাহ্ করতে নিয়ে যায় । তাছাড়া কোন গ্রামে যদি কোন লোক মারা যায়, সে সময় মৃত দেহটি দাহ্ না করা পর্যন্ত ঢোল বাজায় । খিয়াংদের বিশ্বাস মতে, এক ধরনের বড় পাখি এসে নাকি মৃত দেহটি উড়িয়ে নিয়ে যায় । তাই মানুষ মরে গেলে ঢোলটি বাজানো হয় । ঢোলের শব্দে নাকি পাখিটি আসে না বলে তাদের বিশ্বাস রয়েছে । কয়েক ধরনের ঢোল নিজেরা তৈরী করে ব্যবহার করে । বর্তমানে এই ঢোলগুলো খিয়াং সমাজে খুবই কম ব্যবহার করতে দেখা যায় । বর্তমানে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী খিয়াংরা চার্চে ঢোল বাঁজিয়ে উপাসনা করতে দেখা যায় ।
বর্তমানে ব্যবহৃত ঢোল
৩। তেংতেলেহ্: এটি এক মুখী গোলাকার ঢোল । এই ঢোলটি গলায় ঝুলিয়ে দু’টি লাঠির সাহায্যে বাজানো হয় । অন্যান্যরা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব সাংগ্রাই, বিজু বা বৈসু বলে। খিয়াংরা এই উৎসবকে বলে সাংলান । সাংলান বা হেনেই ও অন্যান্য উৎসবে এই গোলাকার ঢোলটি(তেংতেলেহ্) ব্যবহার করে থাকে । কালের আবর্তে এই বাদ্যযন্ত্রটিও খিয়াং সামাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে এই বাদ্যযন্ত্রটি আর ব্যবহার করতে দেখা যায় না ।
৪। ক্রেই/ক্লেই(বাঁশি) : খিয়াংরা নিজস্ব ধংঙে বাঁশ দিয়ে বাঁশি তৈরী করে থাকে । বাঁশির উপর তারা নানা রকমের কারুকাজ করতেও দেখা যায় । সাধারণত: জুমে ধান বা অন্যান্য শষ্যাদি রোপণের পর কয়েক মাসের মধ্যে জুমে খিয়াং ভাষায় (পেং ইম) এ স্ব-পরিবারে উঠে । এ সময় ঘরের যুবক যুবতীরাও চলে যায় তাদের মা বাবাদের সাথে জুম চাষে সাহায্য করতে । তাদের এই জুম চাষকে কেন্দ্র করে যুবক আর যুবতীর মধ্যে কয়েকমাস একে অপরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয় না । সে সময় এক পাহাড় থেকে বাঁশি বাঁজিয়ে অন্য পাহাড়ের জুম চাষরত যুবতীকে যুবক তার বাঁশির সুর দিয়ে উপস্থিতির ঘোষণা দেয় । এভাবে তাদের মধ্যে একে অপরের মধ্যে বাঁশির সুর চালাচালি করে যোগাযোগ রক্ষা করত । বাঁশির সুর শুনে কোন যুবক বা যুবতী তাদের মনের কথা ও ভাব বিনিময় বাঁশির সুরে আদান প্রদান করে থাকে । বাঁশির নিজস্ব সুর বলতে আলাদ নেই । সাধারনত: বলা হয় ছেলে ও মেয়ের সুর । কোন যুবক তার বাঁশির সুরে বিভিন্ন রকমের ফুলের নাম ব্যবহার করে থাকে । সেই ফুলের নামের অর্থ তখন যুবতীটি বুঝতে পারে তার সুরে পাল্টা জবাব দিয়ে থাকে ।
খিয়াংদের ব্যবহৃত ক্রেই(বাঁশী)
৫। চোং: খিয়াংরা এই বাদ্যযন্ত্রটি নিজেরা তৈরী করে থাকে । এই বাদ্য যন্ত্রটি দেখতে অনেকটা গীটারের মত । তিনটি তার বিশিষ্ট এই বাদ্য যন্ত্রটি যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে বাজানো হয় ।
৬। ডিংকোলোকোং: এই বাদ্যযন্ত্রটি বড় বাঁশ দিয়ে তৈরী করে থাকে । বড় বাঁশের টুকরা নিয়ে উপরের কিছু অংশ ছিদ্র করে বা ছেঁটে দিয়ে এই বাদ্যযন্ত্রটি তৈরী করে থাকে । বাঁশের মধ্যে দু’টি লাঠি দিয়ে তালে তালে এটি বাজিয়ে থাকে । এই বাদ্যযন্ত্রটি জুমে ব্যবহার করে থাকে । জুমের শষ্যাদি বন্য প্রাণীর উৎপাত থেকে রক্ষার জন্য এই বাদ্য যন্ত্রটি ব্যবহার করে থাকে । তাছাড়া বিভিন্ন গীত গানে তালে তালে এটি বাজানো হয় । বর্তমানে এই বাদ্য যন্ত্রটিও আর দেখা যায় না ।
৭। খিংখোং : এটি বাঁশের শলা দিয়ে তৈরী করে থাকে । মুখের সাথে লাগিয়ে এটিকে বাজানো যায় । অবসর সময়ে এই বাদ্য যন্ত্রটি বাজিয়ে থাকে ।
৮। রাংখোয়াং : বাংলায় এটিকে জুরি বলে । এই বাদ্য যন্ত্রটি পিতল দিয়ে তৈরী করা হয় । সাধারণত: জুরি দু’টি অংশ সমান থাকে । এটির একটি অংশ পিতলের ছোট আকারের থালার মত দেখতে এবং অন্যটি পিতলের ছোট বাটির মত । এই বাদ্য যন্ত্রটিও সাংলান, হেনেই ইত্যাদি উৎসবে ব্যবহার করে থাকে ।
খিয়াং আদিবাসীদের পূজা-পার্বন
খিয়াং আদিবাসীদের পূজা-পার্বন
বৃহত্তর পার্বত্যাঞ্চলে খিয়াংরা কবে, কোথায়, কখন এবং কিভাবে জীবন যাত্রা শুরু করেছিল তা অনেকের অজানা । তবে এটা সত্যি যে, এই সংখ্যালঘূ খিয়াংরাও অন্যান্য আদিবাসীদের সাথে সহবস্থানে থেকে যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে । অন্যান্য আদিবাসীদের সাথে সাথে খিয়াংরাও এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল বলে অনেকেই অভিমত পোষণ করেছেন । কারণ খিয়াংদের প্রাত্যহিক জীবনের ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি ও পূজা পার্বণ ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্যান্য আদিবাসীদের সাথে অনেকটা সামঞ্জস্য রয়েছে । এক সময় ছিল যখন তারা নিজেদের বৈদ্যান্তিক শক্তি দ্বারা মন্দ দেব-দেবীদের নিয়ন্ত্রণ ও পূজা-অর্চণা করত । আর তাদের নিজস্ব কবিরাজি বিদ্যা দিয়ে পাহাড়ি গাছ-গাছালি দ্বারা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সেবা দিত । এই সকল বিদ্যা তারা পুরুষানুক্রমে রপ্ত করত । কালের আবর্তে মিশ্র সংস্কৃতির আবহের কারণে তাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য বৈদ্যান্তিব বিদ্যা এবং কবিরাজ শান্ত্র চিরতরে হারিয়ে গেছে । তাছাড়া ধর্মীয় অনুশাসনের ফলে এবং শিক্ষার অভাবে সংরক্ষিত না থাকার কারণে অনেক ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানাদি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে । ঠিক তদ্রুপ খিয়াংদের বিভিন্ন পূজা-পার্বন ও হারিয়ে যেতে বসেছে । তাছাড়া সমাজের তাদের নিজস্ব আইন কানুন দ্বারা সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করত । এছাড়াও অন্যান্য আদিবাসীদের বিভিন্ন পূজা সম্পর্কেও তাদের ভাল জ্ঞান বা ধারণা ছিল । যে কেউ ইচ্ছা করলে বিভিন্ন দেবতা-দেবীর কাছে পূজা দিতে পারত না । এই বিষয়ে দক্ষ লোকেরাই এ সকল পূজা দিতে পারত । কোন গ্রামে যদি খিয়াংদের মধ্যে পূজা দেবার মত অভিজ্ঞ লোক না থাকত, তাহলে অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের এনে সেই পূজার কাজ সম্পন্ন করতে হত । এভাবে একে অপরের সহায়তায় পূজার কাজ সম্পন্ন করা হত বলে অন্য আদিবাসীদের পূজার সাথে অনেকটা সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। ঠিক তদ্রুপ কোন আদিবাসীর গ্রামে যদি পূজা দেবার মত কোন দক্ষ লোক না থাকত, তাহলে খিয়াং সম্প্রদায়ের দক্ষ লোককে নিয়ে গিয়ে পূজার কাজ সম্পন্ন করতে হত । অতীতে খিয়াংদের পূজার কাজে বা বৈদ্যান্তিক ধ্যাণ ধারনার বিদ্যায় যথেষ্ট সুনাম ছিল । অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাদের বৈদ্যান্তিক বিদ্যার পারদর্শিতার জন্য বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করত বলে জানা গেছে ।
অনেকের ধারণা মতে খিয়াংরা প্রাকৃতির পূজারী ছিল। তারা প্রাকৃতিক বিভিন্ন উৎস বা শক্তিকে পূজা করত । এখনো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী খিয়াংরা বিভিন্ন দেব-দেবীর কাছে তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে পূজা দিয়ে থাকে ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কে এই সকল পূজা দিতে পারে? যিনি সাধারণত বিশেষভাবে পূজা দেবার কাজে অভিজ্ঞ সেই লোকই পূজা দিতে পারত । এই পূজা দেবার কাজে অভিজ্ঞ লোককে খিয়াং ভাষায় বলা হয় “নাত সারা” । এর বাংলা অর্থ ভূতের শিক্ষক । এই নাত সারাকে কিছুটা হলেও মন্ত্র-তন্ত্র বিদ্যা জানতে হয় । নতুবা পূজা দিতে গিয়ে সেই ভুত বা দেবতাকে দমিয়ে রাখতে না পারলে হিতে বিপরিত হবার সম্ভাবনা থাকে বলে নিজেদের আত্ম রক্ষা মূলক মন্ত্র-তন্ত্র বিদ্যা অর্জন করতে হয় ।
খিয়াংরা যে সকল পূজা কখন, কোথায়, কিভাবে দিয়ে থাকে তার বিবরণ নিম্নে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হল ।
১। মীনা
২। খোয়োংহ্নারাং
৩। রিজা খোয়োং হ্নারাং
৪। চুং
৫। চুংমাংলে
৬। সৈত্যবীল
৭। চ্ িনি
৮। ক্রাক হ্না
৯। লুং নাত
১০। মোটক্যা
১১। লুক তেই ফুক
১২। খোয়োং খাট
১৩। বুগেলে
১। মিনা :
কখনো খিয়াং সমাজের কোন লোক অসুস্থ হলে বৈদ্য প্রথমে গণনা করে দেখবে । অসুস্থ রোগীকে কোন ভুত, প্রেত বা মন্দ আত্মা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বা সেই রোগীর উপর ভর করেছে । তখন কোন বৈদ্যকে ডেকে এনে এক ধরণের বাঁশকে মন্ত্র পড়ে গণনা করে দেখে । সেই বাঁশ দিয়ে গণনা করে দেখাকে খিয়াং ভাষায় বলা হয় য়ো হ্লম । এর বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় বাঁশের নাচ । সেই বৈদ্য তখন ঘোষণা করবে রোগীটি অমুক দেবতা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে । সেই বৈদ্য যদি ঘোষণা করে যে মিনা দ্বারা রোগীটি আক্রান্ত হয়েছে । তখন সেই মিনাকে পূজা দেবার জন্য সকল প্র¯ত্তুতি করা হয় । সেই গণনাকারী তখন ঘরের লোকজনদের জানিয়ে দেয় মিনাকে কি পশু দিয়ে পূজা দেবে । সাধারনত: শুকর, মুরগী বা হাঁস দিয়ে পূজা দিতে হয় । গণনাকারীই তখন ঘোষণা দেন যে, এই রোগীর জন্য মিনা শুকর চেয়েছে । তখন শুকরকে বলি দিতে হয় । তারা মনে করে মিনা হচ্ছে গর্তের দেবী । এ সময় গণনাকারী কোন ছড়া বা ঝর্ণায় পশু বলি দিতে হবে সেই জায়গাও নির্ধারণ করে থাকেন । যদি শুকর দিতে হবে বলে পরিবারকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেই নির্ধারিত জায়গায় শুকর নিয়ে গিয়ে বলি দিতে হয় । সেই বলি দেওয়া শুকরকে ঘরে এনে রান্না করে নির্ধারিত জায়গায় পূজা দিয়ে আসতে হবে । এই সময় শুকর মাংশের সাথে ভাত, চিড়া ও সাত ধরনের তরকারী রান্না সামগ্রী উপকরণ দিতে হবে । পূজা শেষে বৈদ্য বা নাত সারা ঘরে এসে একটি পাত্রের মাধ্যমে তুলা পানিতে চুবিয়ে রোগীর মাথার উপর মন্ত্র পড়ে সেই অসুস্থ আত্মাকে যাঞ্চা করে । এছাড়াও এই পূজাতে ডিম ও মুরগী দিতে হয় । রান্না করা শুকর মাংস পরিবারের সকলে খেতে পারে । সেই পূজায় রান্না করা মাংস বৈদ্য বা নাত সারা সহ বয়োজ্যেষ্ঠ নিমন্ত্রিত অতিথিরা মদ দিয়ে খাওয়া দাওয়া করে ।
২। খোয়োংহ্নারাং:
উপরে উল্লিখিত নিয়মে বৈদ্য বা নাত সারা দ্বারা এই পূজাটিও করতে হয় । খোয়েংহ্নারা হচ্ছে ছড়ার দেবী । এই পূজাটি কেবলমাত্র ছাগল(ছাগী) দিয়ে দিতে হয় । এই পূজার সময় ডিম ও মুরগীর ছানাও বলি দিতে হবে । ছাগীটিকে নির্দ্দিষ্ট জায়গায় কাটতে হবে । পূজার স্থানে চারটি খুঁটি দিয়ে ছোট করে মাচা ঘর তৈরী করতে হবে । সেই মাচার উপরে খই, চিড়া ইত্যাদি দিয়ে কলা পাতার উপর সাজিয়ে রাখতে হবে । পূজা দেবার জায়গার কাছে কোন ছড়া থাকলে সেখানের ছড়া হতে মাছ ধরার চেওয়া দিয়ে মাছ ধরতে হবে । প্রথম চেওড়া দিয়ে পাওয়া কোন মাছ বা কাঁকড়া হচ্ছে সেই অসুস্থ রোগীর আত্মা বলে তাদের বিশ্বাস । সেই প্রথম পাওয়া মাছ বা কাঁকড়া রোগীর মাথার উপর রেখে মন্ত্র পড়ে তার আত্মাকে যাঞ্চা করে । তখন মন্ত্র পড়ে সুতা কয়েক প্যাঁচ দিয়ে রোগীর হাতে বেঁধে দেওয়া হয় । পূজা দেবার শেষে সকলে সেই ছাগীর মাংস মদসহ খাওয়া দাওয়া করে ।
৩। রিজা খোয়োং হ্নারাং:
রিজা খোয়োং হ্নারাং হচ্ছে, তাদের বিশ্বাস মতে সকল দেব-দেবীদের মধ্যে হিংস্র দেবী । এটিও ছাগল দিয়ে পূজা দিতে হয় । পূজার স্থানে প্রথমে চারটি কোনায় বাঁশ দিয়ে তৈরী বিশেষ খুঁটির মধ্যে মাচা ঘর তৈরী করতে হয় । প্রথমে ছাগলকে কেটে চামড়া ছুলে পরে পুণরায় সেই চামড়া মুড়িয়ে দিয়ে আগের অবস্থায় রেখে দিতে হয় । পরে সেই ছাগলকে ধাঁরালো দা দিয়ে পুণরায় কাটতে হয় । পূজার স্থানে বাঁশ দিয়ে ছোট আকারের ভেলা তৈরী করে তার উপর কলাপাতা বিছিয়ে দিয়ে খই, চিড়া আর মুরগীর মাথা রাখতে হয় । এই পূজা দেবার সময় সংঙ্গে করে অল্প পরিমানে ভাত নিয়ে যেতে হয় । কিছু মন্ত্র দিয়ে সেই পূজার কাজ সম্পন্ন করে থাকে ।
৪। চুং:
চুং হচ্ছে ঘরের দেবতা বা দেবী । এটি বিশেষভাবে ঘরের কারো ডায়রিয়া, পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি হলে এই চুং পূজা দিতে হয় । এই পূজা দিতে একটি শুকর, মুরগীর ছানা ও ডিম প্রয়োজন হয় । প্রথমে ঘরের সিঁড়ির কাছে ছোট একটা পূজার ঘর তৈরী করতে হয় । সেই ঘর তৈরী করে শুকর কেটে সেই মাংস রান্না করে মাচা ঘরের মধ্যে পূজার বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সাজিয়ে রাখতে হবে । সাজানো উপকরণগুলো পরিস্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হয় । এ সময় অসুস্থ রোগীর মাথার উপরে পূজার কিছু উপরকণ দিয়ে মন্ত্র পড়ে তার আত্মাকে যাঞ্চা করতে হয়। পরে পূজার শেষে সেই রান্না করা শুকর দিয়ে খাওয়া দাওয়ার পর পরই নাত সারা সেই মাচা ঘর সহ পূজার উপকরণগুলো ফেলে দেয় ।
৫। চুংমাংলে:
কোন পরিবারে যদি কোন লোক অসুস্থ হলে বা মদ তৈরীতে পরিমানে কম মদ হলে এই চুংমাংলে পূজাটি দিতে হয় । কোন মোরগ বা মুরগী দিয়ে এই পূজাটি দিলে চলবে । ঘরের লোকেরা যে দিকে মাথা রেখে ঘুমায় সেইদিকে এই পূজাটি দিতে হয় । তিনটি বাঁশের চোঙ্গা দিয়ে ঘরের কোনায় কিছু পানি ও বিশেষ এক ধরণের গাছের পাতা দিয়ে সাজিয়ে রাখে । সেই বিশেষ ঘাস জাতীয় গাছকে খিয়াংরা বিড়িহ্ সেই থিং বা বিড়ির গাছ বলে । এই পূজাটি ঘরের গৃহকর্তা দিয়ে থাকে । এই পূজা দেবার সময় যে কোন লোককে সাহায্যকারী হিসেবে আমন্ত্রণ জানাতে পারে । প্রথমে মুরগী কেটে রক্তগুলো ঘরের নির্দ্দিষ্ট জায়গায় ছিঁটিয়ে দেয় এবং সেই তৈরী করা চোঙ্গার মধ্যে কয়েক ফোঁটা দিতে হয় । এই পূজাটি দিতে কোন মন্ত্র জপ করতে হয় না । পরে সেই মুরগীর মাংস দিয়ে খাবার খেয়ে পূজার সাজানো উপকরণগুলো ফেলে দেয় । এভাবেই ঘরের গৃহকর্তা চুংমাংলে পূজাটি নিজেই সু-সম্পন্ন করে থাকে ।
৬। সৈত্যবীল : এটিও দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে এক ধরণের পূজা । এই পূজাকে একটি মঙ্গলসূচক পূজা বা খাওয়া দাওয়া পূজা হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে । এই পূজাটি সাধারনত: বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর একজন পুরোহিত পরিচালনা করে থাকে । এটি গ্রামবাসীদের একটি খাওয়া দাওয়ার উৎসবও বলা যেতে পারে । এই উৎসবের মধ্য দিয়ে গ্রামবাসীরা সকলে একাতœতা ঘোষণা করে থাকে । গ্রামবাসীরা সকলে মিলে মিশে পরিমাণমত চাল ঢেঁকিতে গুড়ি করবে । চাউলের গুড়ি, নারিকেল, গুড়, আখ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিষ একটা গামলায় বা ডেসকিতে ভালভাবে মিশিয়ে দেয় । এই সকল মিশানো জিনিষটাকেই খিয়াং ভাষায় সৈত্যবীল বলা হয় । সেই মিশানো ডেসকি বা গামলার চারিপার্শ্বে লোকেরা বসে সেই গামলা হতে নিয়ে তৃপ্তি সহকারে একসাথে খায় এবং আড্ডা দিয়ে সারাদিন কাটিয়ে দেন। তাদের বিশ্বাস মতে এই সৈত্যবীল খাবারের মাধ্যমে শরীরের অসুস্থতা, অমঙ্গল ও অসুচি ইত্যাদি নানা প্রকার প্রভাব হতে বিপদ মুক্ত হতে সাহায্য করে ।
৭। চ্ িনি : চ্ িনি অর্থাৎ শনি পূজা । গ্রামের কোন লোক মানত করে যে এ বছর যদি দেবতা আমার পরিবারের সকল লোককে সুস্থ রাখে তাহলে দেবতার উদ্দেশ্যে একটি গরু বলি দিয়ে চ্ িনি পূজা করবো বলে গ্রামবাসীদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন । যদি কোন অসুখ বিসুখ ছাড়া সেই পরিবার সুন্দরভাবে থাকে এবং জুমের ফসলাদি যদি আশানুরুপ উৎপাদিত হয় তাহলে বছরের সুবিধানুযায়ী সময় গরু জবাই দিয়ে চিনি উৎসবটি পালন করে । তারা বিশ্বাস করে সারা বছরই দেবতা তাদের অনুগ্রহ বা আর্শীবাদ করেছে । সেই কারণেই সেই দেবতাকে খুশী করার জন্য বছরের সুবিধানুয়ায়ী চিনি পূজা করে থাকে । চিনি পূজার গরু নিজেরা জবাই করে না । গরু জবাই করার জন্য একজন কসাইকে ভাড়া করে আনতে হয় । নির্দ্দিষ্ট জায়গায় গর্ত করে সেখানেই গরু জবাই দিতে হয় । কসাই গরুটি জবাই করার পর তিন ভাগের এক ভাগ কসাইসহ যারা জবাই করার জন্য সাহায্য করেছে তাদের ভাগ দিতে হয় । সকল অনুষ্ঠানাদি শেষ করে রান্না করা গরুর মাংস দিয়ে গ্রামবাসীরা দলে দলে খেতে বসে । এ সময় গ্রামবাসীরা সকলে সেই পরিবারের সাথে যুক্ত হয়ে রান্না বান্না ও খাবার পরিবেশন সহ বিভিন্ন কাজে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে । এ সময় মদ পান করে সকলে আনন্দ ফূর্তি করে থাকে । এই পূজাটি মুলত: দেবতাকে খুশী করা বা উৎকোচ দেওয়ার সামিল ।
৮। ক্রাক হ্না:
ঘরের কোন শিশু সারাক্ষন কান্না-কাটি করলে বা বিশেষ করে রাত্রে ঘুমাতে না পারলে ক্রাক হ্না পূজা করে থাকে । তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী তখন মনে করা হয় শিশুটির উপর ক্রাক হ্না এর প্রভাব পড়েছে । ক্রাক হ্না হচ্ছে দেবী । সেই দেবী ঘরের ছাদের মধ্যে অবস্থান করে বলে তাদের বিশ্বাস । ঘরের ছাদের মধ্যে এই পূজা দিতে হয় । বৈদ্য বা মন্দ প্রেত আত্মার সাধক(নাত সারা) এই পূজা দিয়ে থাকে । প্রথমে ঘরের ছাদের উপর মুরগী জবাই করে পরে পূজার বিভিন্ন উপকরণ সামগ্রী দিয়ে পূজার কাজ সম্পন্ন করতে হয় । এই পূজার মুরগী যদি ছানা হয়, তাহলে সেই পূজার পর মুরগীর ছানাটি ফেলে দেয় । আর যদি বড় মোরগ বা মুরগী দিয়ে পূজা দেয় তাহলে সেই মুরগীর মাংস রান্না করে খেতে পারে । এখানে উল্লেখ্য যে, যতক্ষন পর্যন্ত এই পূজা দেবার কাজ শেষ না হবে, ততক্ষন কাছে অবস্থানরত কোন লোক কথা বলতে পারবে না । পূজার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সকলকেই নীরব থাকতে হয় ।
৯। লুং নাত:
খিয়াং ভাষায় লুং অর্থ পাথর আর নাত অর্থ ভূত বা মন্দ আত্মা । পরিবারের মধ্যে কারও জ্বর, ব্যথা বেদনা, চলাফেরা করতে পারে না ইত্যাদি হলে বুঝতে হবে তার উপর লুং নাতের প্রভাব পড়েছে । এই দেবতাকে পূজা দিতে হবে পাঠা ছাগল দিয়ে । এই লুং নাত সাধারনত অবস্থান করে ছড়াতে, পাহাড়ে বা গাছের নীচে । গণনাকারী পূজার জন্য নির্দ্দিষ্ট জায়গা বলে দেবে । সেই মত করে ছড়াতে, পাহাড়ে বা গাছের নীচে পূজা দিতে হবে । পাঠা ছাগলকে পূজার স্থানে নিয়ে গিয়ে বলি দিতে হবে । সেখানে ছোট একটা মাচা ঘর তৈরী করে পূজার বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে পূজার কাজ সম্পন্ন করতে হয় । পূজার কাজ সমাপ্ত হলে সেই ছাগলের রান্না করা মাংস দিয়ে নিমন্ত্রিত অতিথি ও পরিবারের সকলে মদ দিয়ে খাওয়া দাওয়া করে । এখানে উল্লেখ্য, এই রান্না করা মাংস ও ভাত ঘরের মাচা ঘরের নীচে খেতে হবে । ঘরের মধ্যে কোনভাবে খাওয়া যাবে না ।
১০। মোট কিয়া:
এই পূজাটি মুরগী দিয়ে দিতে হয় । পরিবারের কারো যদি হাত পা মচকে যায় বা শরীরের কোন জায়গায় কেটে যায় তাহলে এই পূজাটি দেবতার উদ্দেশ্যে করতে হয়ে । বাঁশের দ্বারা বিশেষ উপরকরণ তৈরী করে এই পূজাটি সুসম্পন্ন করে থাকে । এই পূজাটি যে কোন জায়গায় বা ঘরের কাছেও করতে পারে । দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা দিলে আরোগ্যতা লাভ করবে বলে তাদের ধারণা । এই পূজা করতে পূর্বেকার ছোট আকারের মাচা ঘর তৈরী করে তার উপরে পূজার সকল দ্রব্য সাজিয়ে রাখতে হয় । তারপর কিছু মন্ত্র পড়ে এই পূজার কাজ সমাপ্ত করে ।
১১। লুক তৈই ফুক:
পরিবারের কোন লোক পাগল হলে বা পাগলামী করলে লুক তৈই ফুক পূজা দিতে হয় । গণনাকারী গণনা করে দেখে যে কি দিয়ে এই পূজা দিতে হবে । তিনি যদি শুকর বা কুকুর দিয়ে এই দেবতাকে পূজা দিতে হবে বলে ঘোষণা করেন তাহলে তার কথা মত পূজা দিতে হবে । বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এই পূজাটি দিতে হয় কুকুর দিয়ে । যে বৈদ্য এই পূজাটি দেবে, তাকে অনেক বেশী সাহসী হতে হয় । কারণ রাতের বেলা কবর স্থানে গিয়ে এই পূজাটি দিতে হয় । যদি এই পূজাটি শুকর দিয়ে দিতে হয় তাহলে রান্না বান্না ঘরের বাইরে করতে হবে । সেই শুকরের মাংস যিনি পূজার কাজ সুসম্পন্ন করেন তাকে রান্না করে খাবার পরিবেশন করতে হয় । কুকুর দিয়ে পূজা দিলে পূজার কাজ সমাপ্ত করে সেই কুকুরকে অন্যত্র ফেলে দিতে হয় । সকল পূজার কাজ বৈদ্যের কথা মতে হতে হবে । সেজন্য তিনি যা কিছু প্রয়োজন মনে করেন সকল উপকরণ সেই পরিবারকে অবশ্যই জোগান দিতে হবে ।
১২। খোয়োং খাত:
ছোট ছেলে মেয়রা ছড়াতে বা ঝর্ণাতে গোসল করতে যায় । কোন পরিবারের ছেলে মেয়ে কোন ছড়াতে বা ঝর্ণায় গোসল করতে গিয়ে যদি অসুস্থ বা জ্বর হয় তাহলে খোয়োং খাত পূজাটি দিতে হয় । তাছাড়া কোন শিশু সন্তানের মা ছড়াতে পানি তুলতে বা গোসল করার কারণে যদি শিশু বাচ্চাটি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন তারা বিশ্বাস করে যে খোয়োং খাত দেবতায় ধরেছে । পূজাটি দিতে হয় ছড়া বা ঝর্ণায় । এই পূজায় ছোট মুরগীর ছানা বা বড় মুরগীও দিতে পারে । ছোট মুরগী হলে পূজার শেষে ফেলে দেয় । আর বড় হলে পূজার শেষে রান্না করে পরিবারের সকলে খেতে পারে । পূজাটি দিতে বাঁশের তিনটি খুঁটির আকারে তৈরী করো
১৩। বুগেলে: জুমে ধান রোপণের পর দেবতার উদ্দেশ্যে এই অনুষ্ঠানটি করে থাকে । যখন জুমের ধানের চারা উঠে, তখন জুমে শুকর বলি উৎসর্গ করে বুগেলে করে । এই পূজার উদ্দেশ্য হচ্ছে জুমের ধান, তুলা ও অন্যান্য ফসলাদি ভালভাবে বন্য প্রাণী থেকে রক্ষা পেয়ে যেন অধিক ফলন হয় । এই পূজাটা কিছুটা লক্ষী পূজার মত । শুকর কেটে গ্রামের আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে ভোজে মদ ও মাংস খাওয়া দাওয়া করে । বুগেলে পূজা নিয়ে একটি কল্প কাহিনী রয়েছে ।
অনেক অনেক বছর আগের কথা । কোন এক গ্রামে এক দম্পতি বসবাস করত । তারা নি:সন্তান ছিল । অভাব অনাটনে তাদের দিন কোন ভাবে কেটে যাচ্ছিল । এক সময় তাদের ঘরের চাউল ফুরিয়ে গেল । একদিন রাত্রে ধবধবে সাদা কাপড় পড়িহিত এক বুড়ি তাদের বাড়ীতে এসে হাজির হল । বুড়ি তাদের ঘরে উঠে তাদের কাছে খাবার চাইল । সেই দম্পতি বুড়িকে জানিয়ে দিল যে, সামান্য পরিমানে যতটুকু চাউল ছিল তা রান্না করে তারা খেয়ে নিয়েছে । তাদের উনুনে বসানোর মত আর কোন খাবার বা চাউল নেই । তখন বুড়িটি বলল, নাতি তোমরা দেখ, তোমাদের চাউলের থুরুং এ কোন ধান আছে কিনা । বুড়িটি সেই দম্পতিদের নাতী নাতনি বলে সম্বোধন করত । সেই গৃহের গৃহকর্তার স্ত্রী দেখল যে, তাদের চাউলের থুরুং এ কেবলমাত্র তিনটি চাউল পাওয়া গেছে । গৃহ কর্ত্রী বুড়িকে জানিয়ে দিল যে, থুরুং এ তিনটি চাউল পাওয়া গেছে । যে তিনটি চাউল পাওয়া গেছে সেই চাউল উনুনে বসানোর জন্য বুড়িটি নির্দেশ দিল । বুড়ির কথা অনুযায়ী গৃহকর্ত্রী সেই কয়েকখানা চাউল উনুনে বসিয়ে দিলেন । কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, সেই তিনটি চাউল বসানো পাতিলটি ভরে গেছে । সেই ভাত সুস্বাদু এবং ঘ্রাণপূর্ণ ভাতে পরিণত হয়ে গেল। সেই রাত্রিতে সেই ভাত খেয়ে বুড়িটি তৃপ্ত সহকারে ঘুমিয়ে পড়লেন । ভোরবেলা বুড়িটি বলল, নাতি নাতনি তোমরা জুম কাটার জন্য একটা জায়গা ঠিক কর । নাতি নাতনি বুড়িকে জানাল যে, আমরা যে জুম চাষ করব আমাদের কাছে তো কোন ধানের বীজ নেই । বুড়িটি তখন বলল, তুমি পাশের গ্রামে গিয়ে ধান মাপার জায়গা খুসী খুঁজে আন । নাতি গিয়ে পাশের গ্রাম থেকে খুসী নিয়ে আনলেন । বুড়িটি নাতিকে আদেশ করলেন, সেই খুসীটি ঝেড়ে নাও । খুসীটি ঝেড়ে তিনটি ধান পাওয়া গেছে । বুড়িটির নির্দেশ অনুযায়ী সময়মত বিরাট একটি জুম কেটে পুড়িয়ে তারা তৈরী করল । বুড়িটি বলল, জুমের মধ্যে সেই তিনটি ধান একটি নীচে অন্যটি মাঝখানে এবং আরো একটি উপড়ে রোপণ করবে । সেই বুড়িটির কথামত দম্পতি উভয়ে সেই তিনটি ধান তিন জায়গায় জুমের মধ্যে রোপণ করে দিল । কয়েকদিন পর দেখা গেল যে, সমস্ত জুম ধানের চারাতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল । জুমের ধান পাকার সময় এল । দম্পতি উভয়ে গেল, জুমে ধান কাটতে । জুমের ধান কাটতে কাটতে তাদের গোলা ঘর পরিপূর্ণ হয়ে গেল । ধান কাটা আর শেষ হল না । ধান কাটতে কাটতে গৃহকর্ত্রী অধৈর্য্য হয়ে গেল । একদিন ধান কাটতে কাটতে তার কাস্তে দিয়ে অধৈর্য্য হয়ে ধানের শীষটিকে আঘাত করল । উভয়ে যখন বাড়ীতে আসল, বুড়িটি গৃহকর্তাকে নালিশ করল । নাতি, আজকে নাতনী আমকে মেরেছে । আমার সমস্ত শরীর খুবই ব্যথা করছে । স্বামী তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি নাকি বুড়িকে মেরেছো । স্ত্রী জবাব দিল, নাতো আমি কেন তাকে মারবো, তাকে মারার কোন প্রশ্নই উঠে না । বুড়িটি তাদের বাড়ীতে আর থাকতে চাইলেন না । বুড়িটি তাদের আদেশ দিয়ে বলল, তোমরা চুলার মধ্যে কয়েক হাঁড়ি পানি গরম করবে । আর তোমাদের ধানের গোলায় সেগুলো ঢালবে । বুড়ির কথা মত তারা পানি গরম করে তাদের ধানের গোলার মধ্যে ঢেলে দিল । বুড়িটি বলল, আমি এখন চলে যাচ্ছি । এই বলে বুড়িটি অজানা এক পথে রওনা দিল । দেখতে দেখতে পথের শেষ প্রান্তে গিয়ে অবশেষে হারিয়ে গেল । এদিকে আর এক ঘটনা ঘটে গেল, বুড়ির আদেশ মত গরম পানি ধানের গোলার মধ্যে ঢালিয়ে দিয়েছিল । যতটুকু পানির মধ্যে সেই ধানগুলো ভিজিয়ে ছিল, সেগুলো ছাড়া অন্য ধান গুলো বুড়ি চলে যাবার সাথে সাথে বুড়ির সাথে উড়ে চলে গেল ।
উপসংহার: খিয়াংরা কবে, কখন, কিভাবে তাদের পূজা পার্বন শুরু করেছিল, তা আজও জানা যায়নি । তবে অনেকের ধারণা মতে, খিয়াংরা অন্যান্য আদিবাসীদের পাশাপাশি তাদের এই পূজা পার্বণের ধ্যাণ ধারণা রপ্ত করেছ বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয় । কারণ অন্যান্য আদিবাসীদের সাথে তাদের পূজা-অর্চণা ইত্যাদির সামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায় ।
তথ্যসূত্র:
প্রয়াত রুইহ্লাঅং খিয়াং,কার্বারী, খামতাং পাড়া, উপজেলা: রোয়াংছড়ি, বান্দরবান পার্বত্য জেলা ।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)