খিয়াংদের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র:
খিয়াং সমাজে এক সময় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিজেরা তৈরী করে ব্যবহার করত । তাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা এই বাদ্য যন্ত্রটি ব্যবহার করে । কালের আবর্তে এই বাদ্যযন্ত্র গুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে । খিয়াংদের ব্যবহৃত কিছু বাদ্যযন্ত্রের তালিকা দেয়া হল ।
১। হ্ঙিয়াং - ম্রো আদিবাসীদের মত বাঁশি
২। চিং - ঢোল
৩। তেংতেলেহ্ - গোলাকারের ঢোল
৪। ক্রেই/ক্লেই- বাঁশের বাঁশি
৫। চোং- গীতারের মত দেখতে । এই বাদ্যযন্ত্রটিতে তিনটি তার থাকে ।
৬। ডিংকোলোকোং- বড় আকারের বাঁশের টুকরাটি ছিদ্র করে তৈরী করা হয় ।
৭। খিংখোং- বাঁশের তৈরী । এটি মুখ দিয়ে বাঁজায় ।
৮। রাংখোয়াং-জুরি
১। হ্ঙিয়াং: এই বাদ্যযন্ত্রটি ম্রো আদিবাসীরা বর্তমানে ব্যবহার করতে দেখা যায় । অতীতে এই ম্রো বাঁশিটি খিয়াংরা তাদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণে ব্যবহার করত । খিয়াংরা এই বাদ্যযন্ত্রটি বাঁশের বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে তৈরী করে থাকে । খিয়াংদের জীবন থেকে এটি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে । এই বাদ্য যন্ত্রটি ব্যবহার করতে আর দেখা যায় না । যখন থেকে হারমোনিয়ামের প্রচলন শুরু হয়, তখন থেকে হ্ঙিয়াং বাদ্যযন্ত্রটির ব্যবহার থেকে বিরত থাকে বলে জানা গেছে । বর্তমানে কিছু কিছু খিয়াং পরিবারে হারমোনিয়াম ব্যবহার করতে দেখা যায় ।
২। চিং (ঢোল) : আমি ছোট বেলায় রাজস্থলীতে আত্মীয়ের ঘরে দেখেছি নিজেদের বানানো ঢোল । এটি প্রথমে গাছের ভিতরের অংশ খোদাই করে তারপর শিকার করা হরিণের চামড়া, ছাগলের চামড়া অথবা গয়ালের চামড়া দিয়ে তৈরী করা হয়। এই ঢোল বেশীর ভাগ ব্যবহার করে জুমের ঘরে । জুমের মধ্যে বন্য প্রাণীদের উৎপাত দেখা দিলে ঢোল বাঁজিয়ে তাড়িয়ে দেয় । তাছাড়া ঢোল বাঁজিয়ে গান করে । কোন পরিবারে যদি মৃত দেহ সৎকার করে, তখনো ঢোল বাজিয়ে মৃত দেহকে স্ব-সম্মানে দাহ্ করতে নিয়ে যায় । তাছাড়া কোন গ্রামে যদি কোন লোক মারা যায়, সে সময় মৃত দেহটি দাহ্ না করা পর্যন্ত ঢোল বাজায় । খিয়াংদের বিশ্বাস মতে, এক ধরনের বড় পাখি এসে নাকি মৃত দেহটি উড়িয়ে নিয়ে যায় । তাই মানুষ মরে গেলে ঢোলটি বাজানো হয় । ঢোলের শব্দে নাকি পাখিটি আসে না বলে তাদের বিশ্বাস রয়েছে । কয়েক ধরনের ঢোল নিজেরা তৈরী করে ব্যবহার করে । বর্তমানে এই ঢোলগুলো খিয়াং সমাজে খুবই কম ব্যবহার করতে দেখা যায় । বর্তমানে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী খিয়াংরা চার্চে ঢোল বাঁজিয়ে উপাসনা করতে দেখা যায় ।
বর্তমানে ব্যবহৃত ঢোল
৩। তেংতেলেহ্: এটি এক মুখী গোলাকার ঢোল । এই ঢোলটি গলায় ঝুলিয়ে দু’টি লাঠির সাহায্যে বাজানো হয় । অন্যান্যরা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব সাংগ্রাই, বিজু বা বৈসু বলে। খিয়াংরা এই উৎসবকে বলে সাংলান । সাংলান বা হেনেই ও অন্যান্য উৎসবে এই গোলাকার ঢোলটি(তেংতেলেহ্) ব্যবহার করে থাকে । কালের আবর্তে এই বাদ্যযন্ত্রটিও খিয়াং সামাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে এই বাদ্যযন্ত্রটি আর ব্যবহার করতে দেখা যায় না ।
৪। ক্রেই/ক্লেই(বাঁশি) : খিয়াংরা নিজস্ব ধংঙে বাঁশ দিয়ে বাঁশি তৈরী করে থাকে । বাঁশির উপর তারা নানা রকমের কারুকাজ করতেও দেখা যায় । সাধারণত: জুমে ধান বা অন্যান্য শষ্যাদি রোপণের পর কয়েক মাসের মধ্যে জুমে খিয়াং ভাষায় (পেং ইম) এ স্ব-পরিবারে উঠে । এ সময় ঘরের যুবক যুবতীরাও চলে যায় তাদের মা বাবাদের সাথে জুম চাষে সাহায্য করতে । তাদের এই জুম চাষকে কেন্দ্র করে যুবক আর যুবতীর মধ্যে কয়েকমাস একে অপরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয় না । সে সময় এক পাহাড় থেকে বাঁশি বাঁজিয়ে অন্য পাহাড়ের জুম চাষরত যুবতীকে যুবক তার বাঁশির সুর দিয়ে উপস্থিতির ঘোষণা দেয় । এভাবে তাদের মধ্যে একে অপরের মধ্যে বাঁশির সুর চালাচালি করে যোগাযোগ রক্ষা করত । বাঁশির সুর শুনে কোন যুবক বা যুবতী তাদের মনের কথা ও ভাব বিনিময় বাঁশির সুরে আদান প্রদান করে থাকে । বাঁশির নিজস্ব সুর বলতে আলাদ নেই । সাধারনত: বলা হয় ছেলে ও মেয়ের সুর । কোন যুবক তার বাঁশির সুরে বিভিন্ন রকমের ফুলের নাম ব্যবহার করে থাকে । সেই ফুলের নামের অর্থ তখন যুবতীটি বুঝতে পারে তার সুরে পাল্টা জবাব দিয়ে থাকে ।
খিয়াংদের ব্যবহৃত ক্রেই(বাঁশী)
৫। চোং: খিয়াংরা এই বাদ্যযন্ত্রটি নিজেরা তৈরী করে থাকে । এই বাদ্য যন্ত্রটি দেখতে অনেকটা গীটারের মত । তিনটি তার বিশিষ্ট এই বাদ্য যন্ত্রটি যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে বাজানো হয় ।
৬। ডিংকোলোকোং: এই বাদ্যযন্ত্রটি বড় বাঁশ দিয়ে তৈরী করে থাকে । বড় বাঁশের টুকরা নিয়ে উপরের কিছু অংশ ছিদ্র করে বা ছেঁটে দিয়ে এই বাদ্যযন্ত্রটি তৈরী করে থাকে । বাঁশের মধ্যে দু’টি লাঠি দিয়ে তালে তালে এটি বাজিয়ে থাকে । এই বাদ্যযন্ত্রটি জুমে ব্যবহার করে থাকে । জুমের শষ্যাদি বন্য প্রাণীর উৎপাত থেকে রক্ষার জন্য এই বাদ্য যন্ত্রটি ব্যবহার করে থাকে । তাছাড়া বিভিন্ন গীত গানে তালে তালে এটি বাজানো হয় । বর্তমানে এই বাদ্য যন্ত্রটিও আর দেখা যায় না ।
৭। খিংখোং : এটি বাঁশের শলা দিয়ে তৈরী করে থাকে । মুখের সাথে লাগিয়ে এটিকে বাজানো যায় । অবসর সময়ে এই বাদ্য যন্ত্রটি বাজিয়ে থাকে ।
৮। রাংখোয়াং : বাংলায় এটিকে জুরি বলে । এই বাদ্য যন্ত্রটি পিতল দিয়ে তৈরী করা হয় । সাধারণত: জুরি দু’টি অংশ সমান থাকে । এটির একটি অংশ পিতলের ছোট আকারের থালার মত দেখতে এবং অন্যটি পিতলের ছোট বাটির মত । এই বাদ্য যন্ত্রটিও সাংলান, হেনেই ইত্যাদি উৎসবে ব্যবহার করে থাকে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন